বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে বর্তমানে ১৭ জন সদস্য আছেন। এই পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস সহ অন্যান্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। এই নিবন্ধে তাদের জীবন বৃত্তান্ত ও পেশাগত ইতিহাস তুলে ধরা হল।
ড. মুহাম্মদ ইউনুস: প্রধান উপদেষ্টা
ড. মুহাম্মদ ইউনুস হলেন একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। তিনি ১৯৪০ সালের ২৮ জুন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ড. ইউনুস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাইক্রোফাইন্যান্স ধারণা প্রচলন করেন, যা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০০৬ সালে, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার অর্জন করেন।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ
সালেহ উদ্দিন আহমেদ হলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। তিনি ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয় এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
ড. আসিফ নজরুল
ড. আসিফ নজরুল একজন লেখক, ঔপন্যাসিক, রাজনীতি বিশ্লেষক, সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং কলামিস্ট। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। ড. নজরুলের জন্ম ১৯৬৬ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন এবং লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস) থেকে পিএইচডি অর্জন করেন। তার বিশ্লেষণী লেখা এবং গবেষণা কাজের জন্য তিনি বহুল পরিচিত।
আদিলুর রহমান খান
আদিলুর রহমান খান হলেন একজন মানবাধিকার কর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন । ১৯৯৪ সালে, তিনি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন যা মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক প্রতিবেদন তৈরি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
হাসান আরিফ
হাসান আরিফ একজন বিশিষ্ট আইনজীবী এবং সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি ফখরুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসান আরিফ তার পেশাগত জীবনে আইন ক্ষেত্রে অনেক অবদান রেখেছেন এবং সুপ্রিম কোর্টে সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
তৌহিদ হোসেন
তৌহিদ হোসেন একজন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব। তার কূটনৈতিক দক্ষতা এবং পররাষ্ট্র নীতিতে বিশেষ অবদান রয়েছে। তৌহিদ হোসেনের নেতৃত্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে শক্তিশালী করেছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান হলেন একজন পরিবেশ কর্মী এবং বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী। তিনি পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং বিভিন্ন পরিবেশগত ইস্যুতে আইনি পদক্ষেপ নিয়েছেন। তার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়িত হয়েছে।
মো. নাহিদ ইসলাম
মো. নাহিদ ইসলাম হলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক। তিনি ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্য এবং অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া
আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বাংলাদেশের একজন উজ্জ্বল ছাত্রনেতা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে পরিচিত। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অসাম্য এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। তার নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলন বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বৈষম্য বিরোধী সচেতনতা সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন হলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং সাবেক নির্বাচন কমিশনার। তিনি সেনাবাহিনীর একজন সম্মানিত কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন এবং নির্বাচন কমিশনে তার কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক করতে ভূমিকা রেখেছেন।
ফরিদা আখতার
ফরিদা আখতার হলেন একজন অর্থনীতিবিদ এবং বেসরকারি সংস্থা উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক। তিনি নারী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে কাজ করেন। তার গবেষণা এবং সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিচিতি লাভ করেছেন।
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায়
অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক। তিনি মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে কাজ করেছেন।
আ.ফ.ম খালিদ হাসান
আ.ফ.ম খালিদ হাসান একজন ইসলামি পণ্ডিত, বাংলাদেশী লেখক ও গবেষক। তিনি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের সাবেক নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার লেখা এবং গবেষণা ইসলামি চিন্তা ও সমাজ উন্নয়নের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
নুরজাহান বেগম
নুরজাহান বেগম গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন এবং নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
সুপ্রদীপ চাকমা: সাবেক রাষ্ট্রদূত
সুপ্রদীপ চাকমা বাংলাদেশের একজন অভিজ্ঞ কূটনীতিক এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত। তার দীর্ঘ কূটনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জোরদারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি পররাষ্ট্র ক্যাডারের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। সুপ্রদীপ চাকমা তার কর্মজীবনে কূটনৈতিক দক্ষতা এবং নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের স্বার্থে অবদান রেখে গেছেন, যা তাকে একটি সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ফারুক-ই-আজম: বীর প্রতীক
ফারুক-ই-আজম বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং “বীর প্রতীক” খেতাবপ্রাপ্ত। তিনি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সাহসিকতার জন্য এই খেতাব অর্জন করেন। যুদ্ধকালীন তার বীরত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড দেশের স্বাধীনতা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতার পর, তিনি সামরিক বাহিনীতে তার সেবা অব্যাহত রাখেন এবং দেশের নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধিতে অবদান রাখেন। ফারুক-ই-আজমের বীরত্ব ও দেশপ্রেম তাকে জাতির গর্বিত সন্তান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
এই নিবন্ধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্ত তুলে ধরা হল। তাদের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শুভকামনা জানিয়েছেন। ড. ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং তার এই নতুন পদে মোদি শুভেচ্ছা ও সাফল্য কামনা করেছেন।
ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত। তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠন ও পরিচালনা হতে যাচ্ছে। মোদি এই সময়ে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে এবং পারস্পরিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এই ঘোষণা দেয়ার সময় বলেছে, তারা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আগ্রহী। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন জানিয়েছে এবং একসাথে কাজ করে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমর্থন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
আমার উপর বিশ্বাস রাখলে প্রতিপক্ষের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন: ড. ইউনূস
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের জনগণের প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “আমার উপর বিশ্বাস রাখলে প্রতিপক্ষের প্রতি সহিংসতা বন্ধ করুন।” ড. ইউনূস বিশ্বাস করেন যে, রাজনৈতিক সহিংসতা সমাজের স্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য একটি বড় বাধা।
ড. ইউনূস, যিনি তার জীবনে শান্তি ও সমতার পক্ষে কাজ করেছেন, তার এই আহ্বান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। তিনি উল্লেখ করেন যে, সহিংসতা কোনো সমস্যার সমাধান নয় বরং এটি আরও বিভক্তি এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। তিনি সবাইকে আহ্বান জানান শান্তি ও সহনশীলতার পথে হাঁটতে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রাখতে।
ড. ইউনূস বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ আমার উপর বিশ্বাস রেখেছে এবং আমি চাই সেই বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে। আমাদের সমাজে বিভেদ এবং সংঘাতের কোনো স্থান নেই। আমাদের উচিত পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা।”
এই আহ্বানের মাধ্যমে ড. ইউনূস তার দেশের মানুষকে একসঙ্গে কাজ করার এবং সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন। তিনি মনে করেন, সহিংসতা কেবলমাত্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিভেদ সৃষ্টি করে।
ড. ইউনূস তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন, যেখানে সবাই সমানভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং কোন রকম ভয় বা সহিংসতা ছাড়াই বসবাস করতে পারে। তার এই আহ্বান দেশের মানুষের মধ্যে নতুন আশা ও আত্মবিশ্বাসের সঞ্চার করেছে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করেছে।