শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো একটি স্থল যেখানে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেকে প্রস্তুত করে একটি দক্ষ, সৃজনশীল এবং নৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তোলে। এই প্রক্রিয়ায় ছাত্রদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং নৈতিক মূল্যবোধও বিকশিত হয়। তবে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির প্রবেশ ঘটে, তখন শিক্ষার এই মূল লক্ষ্যগুলো নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অনেকের মতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। এই নিবন্ধে আমরা এই দাবির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করব এবং কেন এটি শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় তা আলোচনা করব।
১. শিক্ষার মানে বিঘ্ন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের জ্ঞান ও দক্ষতার বিকাশ ঘটানো। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার মানে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, কারণ এটি শিক্ষার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো থেকে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ অন্যত্র নিয়ে যায়। একাধিক ঘটনার সাক্ষী আমরা যেখানে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের অধ্যয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সময় এবং মনোযোগ নষ্ট করেছে। অনেক সময় রাজনীতিতে জড়িত শিক্ষার্থীরা ক্লাস এড়িয়ে সভা, মিছিল, বা আন্দোলনে অংশ নেয়, যা তাদের শিক্ষার ক্ষতি করে। শিক্ষার্থী হিসেবে প্রাথমিক কর্তব্য হল শিক্ষায় মনোযোগ দেওয়া এবং নিজেদের সঠিক জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা। ছাত্ররাজনীতি এই লক্ষ্যে বিঘ্ন ঘটায়।
২. হিংসা ও অস্থিরতা বৃদ্ধি
ছাত্ররাজনীতির অন্যতম নেতিবাচক দিক হল এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিংসা এবং অস্থিরতা বৃদ্ধি পাওয়া। অনেক সময় ছাত্ররাজনীতির নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর পক্ষ নিয়ে কাজ করে এবং এর ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক সংঘর্ষের মঞ্চে পরিণত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন এবং বৈরিতার সৃষ্টি হয়, যা সহিংসতা এবং বিশৃঙ্খলার দিকে ধাবিত করে। এমনকি অনেক সময় শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য সহিংসতা ও অপরাধের সাথে যুক্ত হয়। এই ধরনের পরিবেশ শিক্ষার জন্য মোটেই স্বাস্থ্যকর নয় এবং শিক্ষার্থীদের নৈতিক বিকাশেও বাধা সৃষ্টি করে।
৩. শিক্ষকদের প্রতি অসম্মান
ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষকদের প্রতি অসম্মান বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। অনেক শিক্ষার্থী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে উঠলে তারা শিক্ষকদের সঠিক সম্মান দেয় না এবং তাদের নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ওপর আক্রমণাত্মক আচরণ বা হুমকি দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা যখন রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নিজেদের ক্ষমতাশালী মনে করে, তখন তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও শিক্ষকদের নির্দেশনা মানতে অস্বীকার করে। এটি শিক্ষার পরিবেশকে বিঘ্নিত করে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদাকে হ্রাস করে।
৪. ছাত্রদের মধ্যে বিভাজন
ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের বিভাজন এবং গোষ্ঠীবদ্ধতা তৈরি করে। যখন শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়, তখন তাদের মধ্যে ঐক্য এবং সহযোগিতার অভাব দেখা দেয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার জায়গায় দ্বন্দ্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা জন্ম নেয়। রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে একদল অন্য দলের প্রতি বৈরিতা পোষণ করে এবং এতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৌহার্দ্য ও মৈত্রী নষ্ট হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একটি সুস্থ এবং সহযোগী পরিবেশ তৈরির জন্য কাজ করে, কিন্তু ছাত্ররাজনীতি এই প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে।
৫. শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ঝুঁকি
ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও বিপর্যয় ডেকে আনে। শিক্ষার্থীদের জীবনযাত্রায় ছাত্ররাজনীতির প্রতি আকর্ষণ তাদের শিক্ষাগত লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে এবং তাদের শিক্ষাজীবনের ক্ষতি করতে পারে। অনেক সময় শিক্ষার্থীরা রাজনীতিতে এতটাই জড়িয়ে পড়ে যে তারা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে এবং তারা আর শিক্ষার প্রতি আগ্রহী থাকে না। এর ফলে তাদের চাকরির বাজারে প্রবেশ করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং তারা সমাজে সফল হতে ব্যর্থ হয়। এভাবে ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ এবং কর্মজীবনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
৬. রাজনৈতিক অপব্যবহার
ছাত্ররাজনীতি রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা প্রায়শই অপব্যবহারের শিকার হয়। রাজনৈতিক দলগুলি শিক্ষার্থীদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে এবং তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্ত করে। শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দলের হাতে একটি কৌশলগত উপকরণে পরিণত হয়, যা তাদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি এবং নৈতিকতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থীদের নিজেদের জীবনের জন্য একটি স্বাধীন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকা উচিত, কিন্তু রাজনৈতিক দলের প্রভাব তাদের সেই ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করে এবং তাদের স্বার্থে ব্যবহার করে।
৭. বিকল্প নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ
ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের গুণাবলী বিকাশের জন্য অন্য উপায় খুঁজে পেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষামূলক কার্যক্রম, সামাজিক দায়িত্ব এবং স্বেচ্ছাসেবক কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন করতে পারে। ছাত্ররাজনীতি ছাড়াও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা নিজেদের নেতৃত্বের দক্ষতা, যোগাযোগের ক্ষমতা এবং দলগত কাজের মানসিকতা গড়ে তুলতে পারে। এটি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতে একটি সঠিক এবং সুস্থ নেতৃত্ব গঠনে সাহায্য করবে।
৮. শিক্ষার পরিবেশ সুরক্ষা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হলো জ্ঞানার্জনের স্থান, যেখানে শান্তি, শৃঙ্খলা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষার এই পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণ এবং সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখা সহজ হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষায় মনোনিবেশ করতে পারবে এবং তাদের শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে। এটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্যকে সফলভাবে পালন করতে সাহায্য করবে।
৯. নৈতিক ও সামাজিক উন্নতি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নৈতিক ও সামাজিক উন্নতির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। ছাত্ররাজনীতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক নৈতিকতা এবং সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার প্রক্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। রাজনীতির জটিলতায় জড়িয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীরা সঠিক সামাজিক দায়িত্ববোধ হারিয়ে ফেলে। ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করলে শিক্ষার্থীরা তাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্বগুলো আরও ভালোভাবে পালন করতে সক্ষম হবে, যা সমাজের সামগ্রিক উন্নতির জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
সবকিছু বিবেচনা করে দেখা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার পক্ষে বেশ কয়েকটি শক্তিশালী যুক্তি রয়েছে। এটি শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষা, শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা এবং নেতৃত্বের সঠিক বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। ছাত্ররাজনীতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে অস্থিরতা এবং হিংসার সৃষ্টি হয়, তা শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। শিক্ষার্থীদের একটি সঠিক শিক্ষার পরিবেশ দেওয়ার জন্য এবং তাদের ভবিষ্যৎকে আরও সুস্থ এবং সাফল্যময় করে তোলার জন্য ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।